নদীর গহ্বরে আটকে আছে একেকটা জীবন। কে ফিরবে, কে ফিরবে না! -চরফ্যাসনের প্রতিটি ঝড়েই আতংকে থাকে পরিবার।। 

এম ফাহিম, চরফ্যাসন (ভোলা):

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-বন্যা আর জলদস্যুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় উপকূলীয় এলাকার জেলেদের। এসব দুর্যোগ যেন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কখনো কখনো মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার রাক্ষসী ঢেউ গ্রাস করে নেয় জীবন, কেড়ে নেয় স্বপ্ন।

ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার নদীপাড় ঘেঁষা জনপদে এমন চিত্র প্রায় নিয়মিত ঘটনা। প্রতিবছর বহু জেলে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন। কেউ কেউ ফিরে আসেন লাশ হয়ে, আর বাকিদের পরিবারের জন্য শুরু হয় এক অনিশ্চিত অপেক্ষা—যা কখনো কখনো পেরিয়ে যায় বহু বছর।

গত এক দশকে নিখোঁজ হওয়া জেলেদের স্বজনদের এই অপেক্ষা রূপ নিয়েছে নিঃসঙ্গ কষ্টের গল্পে। বিশেষ করে দুর্যোগের মৌসুম এলেই কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে এসব জেলে পরিবার।

জুন থেকে নভেম্বর—এই সময়টিকে সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে ‘দুর্যোগ মৌসুম’ হিসেবে ধরা হয়। এ সময় ঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে প্রায় নিয়মিত। সেই সঙ্গে জেলে পরিবারে নেমে আসে স্বজন হারানোর আতঙ্ক।

হাজারীগঞ্জ এলাকার জেলে কালাম বলেন, “সাগরে গেলে দুই দিক থেকে ভয় থাকে—একদিকে জলদস্যু, অন্যদিকে ঝড়। কোনো এক দিকেই না, একদিন নিখোঁজ হয়ে যেতে হয়।”

স্থানীয় জেলেরা জানান, দুর্যোগ মৌসুমে ট্রলারডুবির ঘটনা ও নিখোঁজের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।

চরফ্যাসন উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় মোট জেলের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। এর মধ্যে নিবন্ধিত ৪৪ হাজার ২৮১ জন এবং অনিবন্ধিত প্রায় ৪৬ হাজার। মাছ ধরার জন্য রয়েছে প্রায় ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা এবং ৭ হাজার গভীর সমুদ্রগামী ট্রলার।

এসব জেলের মধ্যে ২০১৫-তে ১১ জন, ২০১৬-তে ১৯ জন, ২০১৭-তে ৫ জন, ২০১৯-তে ৪৮ জন, ২০২০ -তে ৯ জন, ২০২১-তে ৯ জন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ জন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৫ জন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ জন জেলে নদী ও সাগরে নৌকা ডুবে প্রাণ হারিয়েছে।

২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারানো সব জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ ৬৬ জেলের মধ্যে ২২ জেলে পরিবারকে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫৮ জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক দেওয়া হয়।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় আরও জানিয়েছে, বিগত বছরের তুলনায় উপজেলায় ২০১৯ সালের শুরু থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১২৪ জন জেলে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে। এদের অনেকের লাশ পাওয়া গেলেও অন্যদের খোঁজ মেলেনি। নিখোঁজ জেলেরা চর মাদ্রাজ, আসলামপুর, মাদ্রাজ, জিন্নাগড়, আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, আহম্মদপুর, ওসমানগঞ্জ, এওয়াজপুর, হাজারিগঞ্জ, জাহানপুর, রসূলপুর, চরমনিকা, চরকুকরি মুকরি, চর পাতিলা, নজরুল নগর, মুজিব নগর, ঢালচর, নুরাবাদ, নীলকমল, আব্দুল্লাহপুর, চরকলমী এলাকার।

নুরাবাদ এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে জামাল (৩৭)। ২০১৯ সালের ১২ জুলাই, সাগরে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন। তার বাবা বলেন, ছেলেটা দিন-রাত সাগরে পড়ে থাকত। কূলে ফেরার দুই দিন আগেই ঝড়ে তাদের ট্রলার ডুবে যায়। সেদিন ট্রলারে থাকা অন্য জেলেরা বেঁচে এলেও আমার ছেলেসহ দুই জেলের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জেলে জামালের মতো একই এলাকার আবদুল জলিল (৪৫), শাহাজাহান (৪২), সুলতান মাঝি (৪৬), আফসার জমাদার (২৯), শাহাজাহান মাঝি (৪১), আব্দুল হাই (৩২), কবির (২৬), নূরনবী (২৮), নজরুল ইসলাম (৩৩) নিখোঁজ রয়েছেন।

সামরাজ মৎস্যঘাট জেলে সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা জেলে পেশায় নিয়োজিত।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিদেরও একই হারে এ টাকা দেওয়া হবে।