
রাসেল আহমেদ, খুলনা:
খুলনা-১ (দাকোপ–বটিয়াঘাটা) আসনে প্রথমবারের মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনকে প্রার্থী করেছে জামায়াতে ইসলামী। ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি কৃষ্ণ নন্দীকে আট দলের বিভাগীয় সমাবেশে প্রার্থী ঘোষণা করার পরই এলাকায় নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
গত ৩ ডিসেম্বর খুলনা শহরে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান তার নাম ঘোষণা করেন। ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু হলেও জামায়াতের প্রার্থী—এই পরিচয়ই নির্বাচনী মাঠে নতুন কৌতূহল ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ঘোষণার কিছু ঘণ্টা পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের এক নেতার সঙ্গে তার তোলা একাধিক ছবি। ওয়ার্ল্ড হিন্দু স্ট্রাগল কমিটির বাংলাদেশ সভাপতি শিপন কুমার বসুর সঙ্গে ওই ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি করছেন, কৃষ্ণ নন্দীর ভারতের অভ্যন্তরীণ একটি সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
ছবিগুলো প্রথম শেয়ার করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, ছবিগুলো ২০১৩ সালের এবং তখন কৃষ্ণ নন্দী ভারতে অবস্থান করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, ছবির ফরেন্সিক পরীক্ষা করে তাতে কোনো ধরনের টেম্পারিং বা এআই ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি ওই বৈঠকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আইবি’র এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে এ অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন কৃষ্ণ নন্দী। তিনি বলেন, “ছবির ব্যক্তিকে আমি চিনি না। একটি এআই ছবি ছড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।”
ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর তার গ্রামের বাড়ি। চুকনগর দিব্যপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে পারিবারিক ব্যবসা শুরু করেন তিনি। মোটরসাইকেল শোরুম, তেল, রড-সিমেন্টসহ একাধিক ব্যবসার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তার দাবি, ২০০৩ সালে সাবেক জামায়াত নেতা ও খুলনা-১ আসনের সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ারের হাত ধরে তিনি জামায়াতে যোগ দেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ ভিন্ন। তারা বলছেন, গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষুব্ধ জনতা তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে তাকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবে খুব সক্রিয় দেখা যায়নি। সেই ঘটনার পর থেকেই তিনি পুনরায় জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন। পরে উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পান। গত ৩১ অক্টোবর তার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত জামায়াতের হিন্দু সম্মেলনে বিপুলসংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যোগ দেওয়ায় তা নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়।
তার রাজনৈতিক অতীত নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগও প্রশ্ন তুলেছে। তাদের দাবি, কৃষ্ণ নন্দী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ঘনিষ্ঠজন। মন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ছড়িয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ওই ঘনিষ্ঠতার কারণেই গত বছরের সহিংসতায় তার ব্যবসা স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়।
তবে কৃষ্ণ নন্দী বলেন, “ব্যবসায়ী হিসেবে মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি এখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
খুলনা-১ আসনটি দেশের অন্যতম হিন্দু অধ্যুষিত আসন। দাকোপ উপজেলায় হিন্দুর সংখ্যা ৫৪ শতাংশের বেশি, বটিয়াঘাটায় প্রায় ২৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে এ আসনের প্রায় ৪৩ শতাংশ ভোটারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ফলে আওয়ামী লীগ এখানে বেশির ভাগ সময়ই জয়ী হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে ননী গোপাল মণ্ডল জয় পান।
জামায়াত ১৯৯৬ সালে এখানে সর্বশেষ প্রার্থী দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর এবার প্রথমে মাওলানা আবু ইউসুফকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও পরে পরিবর্তন করে কৃষ্ণ নন্দীকে চূড়ান্ত প্রার্থী করা হয়। মনোনয়ন হারিয়ে আবু ইউসুফ অবশ্য দলের সিদ্ধান্ত মেনে তার প্রচারণায় নেমেছেন।
এদিকে বিএনপিও এখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটি এবারও আমীর এজাজ খানকে প্রার্থী করেছে। পূর্বের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে তিনিই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন।
সব বিতর্ক ও নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ নন্দী অবশ্য আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছেন না। তার ভাষায়, “এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজন আছে। হিন্দু–মুসলিম সবাইকে নিয়েই আমি নির্বাচন করব। মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে।”
খুলনা-১ আসনের মাঠ এখন উত্তপ্ত। ভাইরাল ছবি, অতীত রাজনৈতিক সম্পর্ক, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট—সব মিলিয়ে কৃষ্ণ নন্দীকে নিয়ে নতুন করে জমছে রাজনৈতিক সমীকরণ। ভোটারদের মনে প্রশ্ন একটাই—বিতর্কের ভিড় পেরিয়ে তিনি কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন?