- জালালাবাদ বার্তা - https://www.jalalabadbarta24.com -

উপকূল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি ও তার শৈল্পিক ঘর

এম ফাহিম, চরফ্যাসন (ভোলা)◾

গ্রামবাংলা থেকে কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে শৈল্পিক কারুকার্য খচিত বাবুই পাখি ও তার বাসা। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকার কারণে বাবুই পাখির বাসা বিলীন হতে চলেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগেও গ্রামগঞ্জের মাঠঘাটের তাল গাছে দেখা যেত এবং সেইসব তালগাছে এদের বাসা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আবারও তালগাছ রোপন করলে বাবুই পাখি পুনরায় বাসা বাঁধবে এবং পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে আসবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় , উপকূলীয় জনপদ চরফ্যাসন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম-গঞ্জে এখন আর আগের এত চোখে পড়ে না বাবুই পাখি ও তার তৈরি দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট বাসা তৈরির নৈসর্গিক দৃশ্য। বাবুই পাখির নিখুঁত বুননে এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কষ্টকর। প্রতিটি তালগাছে ১শ’ থেকে ১৫০টি বাসা তৈরি করতে সময় লাগে ১০-১২ দিন। খড়, কুটা, তালপাতা, ঝাউ ও কাশবন ও লতা-পাতা দিয়ে বাবুই পাখি উঁচু তালগাছে বাসা বাঁধে।

রিকশাচালক আলমগীর (৫৫) বলেন, ‘গ্রামে ৪০ বছর আগে তাল গাছে বাবুই পাখি বাসা বুনতো এবং পাখির কিচিরমিচির শব্দ হোনতে ভালো লাগতো। এমন আর তাল গাছও নেই আর আগের এত পাখির ডাকও শোনা যায় না।’

গ্রামের ভ্যান চালক ফারুক হোসেন (৫২) বলেন, ‘আগের দিনগুলোতে মোরা পাখির ডাক শুনতাম। তালগাছ কমে যাওয়ায় পাখির ডাকও কমে গেছে।’

সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি অনেক মজবুত। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ভেঙে পড়ে না। পুরুষ বাবুই পাখি বাসা তৈরির পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সাথী বানানোর জন্য পুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণীয় করতে খাল, বিল ও ডোবার পানিতে গোসল করে গাছের ডালে ডালে নেচে বেড়ায়।

চমৎকার বাসা বুনে বাস করায় এ পাখির পরিচিতি বিশ্বজোড়া। বাবুই পাখির বাসার ভিতর আধুনিক যুগের মত লাইটের ব্যবস্থা আছে। বাসার ভেতর একটু গোবর রাখা হয়, তার ভেতর জোনাকি পোকার মাথাটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ফলে জোনাকির আলোতে বাসা আলোকিত হয়ে উঠে। কারুকার্যময় এ বাসা দেখিয়ে পুরুষ বাবুই পাখি তার প্রেমিকার মন ভুলিয়ে সখ্যতা গড়ে তোলে। সুনিপুন এ কারিগর এভাবে একের পর এক বাসা তৈরি করে নতুন নতুন সঙ্গী জুটিয়ে নিজ হাতে গড়া সেই বাসায় স্বল্প দিনের সুখের ঘর বাঁধে। এভাবেই আমৃত্যু চলতে থাকে পুরুষ বাবুই পাখির বাসা তৈরি আর সঙ্গী বদলের পালা।

এ বিষয় চা বিক্রেতা মন্নান (৫৫) বলেন, ‘বাবুই পাখির বাসা দেখতে অনেক সুন্দর। এই বাসা নিয়ে ছোট সময়টায় আমরা পুতুল খেলতাম। বাবুই পাখির বাসায় রাতে জোনাকী পোকার মিটমিট আলো জ্বলতো, এসব দৃশ্য খুবই ভালো লাগতো।’

প্রজনন সময় ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির গায়ে পিঠে তামাটে কালো বর্ণের দাগ হয়। নিচের দিকে কোনো দাগ থাকে না। ঠোঁট পুরো মোসাকার ও লেজ চৌকা। তবে প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির রং হয় গাঢ় বাদামি। অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির পিঠের পালকের মতই বাদামি হয়।

চরফ্যাসনের স্থানীয় সংগীতশিল্পী সরণ মজুমদার বলেন, ‘ছোটবেলায় গ্রামের রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলোতে অনেক বাবুই পাখির বাসা ছিল। কিন্তু এখন আর আগের মত তালগাছ দেখা যায় না, আর বাবুই পাখির বাসাও দেখা যায় না। বাবুই পাখির বাসাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আবার তালগাছ লাগানো হলে হয়তবা বাবুই পাখি বাসা তৈরি করবে।’

চরফ্যাসন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ইনকিলাব প্রতিনিধি মো. কামাল গোলদার বলেন, ‘সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে রাস্তায় তালগাছ লাগানো হলে আবার বাবুই পাখি বাসা বুনবে।’

চরফ্যাসন সরকারি কলেজের প্রানীবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তাছলিমা বেগম বলেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আবারও তালগাছ রোপণ করলে বাবুই পাখি পুনরায় বাসা বাঁধবে এবং পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে আসবে।’